Tuesday, December 16, 2025

আহসান উল্লাহ চৌধুরী : কমরেড ফিরবেন, সময়ের প্রয়োজনে

[acf field="reportername"]
আরও পড়ুন

কমরেড ফিরবেন, সময়ের প্রয়োজনে

ইউসুফ সোহেল

১৯৪৭ সালে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শাসনের অবসান হয়েছিল বটে, কিন্তু এর মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে বিভেদ-বিরোধ, জিঘাংসা-হানাহানির বীজ বপন হয়েছিল। এ যেন ধর্মে-ধর্মে, ধর্মভিত্তিক জাতি আর জাতিতে বিভক্তির চিরস্থায়ী সূচনা ! তবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সেই বিভক্তির ভিত্তিমূলে প্রথম আঘাত করে। উত্থান হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের- আমাদের মাটি, মানুষ, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সাবর্জনীনতা যার মূল ভিত্তি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলন একটি প্রগতিশীল আন্দোলনে রূপান্তর হয়, যখন এর সঙ্গে বাম ভাবাদর্শে বিশ্বাসীরা একাত্ম হন। কমরেড আহসান উল্লাহ চৌধুরী ছিলেন সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শে প্রভাবিত একজন ছাত্রনেতা। ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে সেই প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলনের উত্থানের গোড়াপত্তন ঘটেছিল যাদের হাত ধরে, তাঁদের একজন আহসান উল্লাহ চৌধুরী।

প্রসঙ্গটার অবতারণা এ কারণেই যে, সময় সৃষ্টি করেছিল আহসান উল্লাহ চৌধুরীদের আবার সময়ের প্রয়োজনকে ধারণ করেই নিজেদের গড়েছিলেন তিনি এবং তাঁরা। এরপর ষাটের দশকজুড়ে তো বামপন্থার জোয়ার বয়ে গিয়েছিল বিশ্বজুড়ে। আমাদের এ অঞ্চলে সময় তখন ঋষিতুল্য একদল বিপ্লবীর জন্ম দিয়েছিল। পূর্ণেন্দু দস্তিদার, আবদুস সাত্তার, অমর সেন, পূর্ণেন্দু কানুনগো, চৌধুরী হারুন, মওলানা আহমেদুর রহমান আজমী এবং এদের মধ্যে সর্বশেষ হিসেবে যিনি জীবিত ছিলেন তিনি আহসান উল্লাহ চৌধুরী। পরার্থপরতার রাজনীতি দিয়ে তাঁরা একেকজন নিজেকে কিংবদন্তীতে পরিণত করেছেন, যা আজকের সমাজে কল্পনাও করা যায় না।

তৎকালীন সময়ে স্নাতক সম্পন্ন করা শিক্ষিত আহসান উল্লাহ চৌধুরী চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত থাকা অবস্থায় শ্রমিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৫৯ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ততদিনে তিনি বন্দর শ্রমিকদের সামনের সারিরর একজন সংগঠকে পরিণত হন। শ্রমিক নেতা হিসেবেই আইয়ূব শাহীর বিরুদ্ধে রাজপথে লড়াই করেছেন। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামে গণহত্যার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আনা অস্ত্রশস্ত্র সোয়াত জাহাজ থেকে খালাস প্রতিরোধে তিনি দুঃসাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। স্বাধীন দেশে তিনি ট্রেড ইউনিয়নের আন্দোলন, একের পর এক শ্রমিক সংগঠন, স্কপ গড়ে দেশের শ্রমিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। আশির দশকের শেষভাগে স্বৈরাচার এরশাদের পতন হয়। সেই দশকজুড়ে সামরিক শাসকবিরোধী আন্দোলনে শ্রমিকদের যে লড়াকু ভূমিকা, তার অন্যতম নেতৃত্বদাতা ছিলেন আহসান উল্লাহ চৌধুরী। সেই যে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তবাদী আন্দোলনের জোর উত্থান এবং সেটাকে ধারণ করে অন্তঃত মধ্য নব্বই পর্যন্ত ত্যাগ ও নীতিনিষ্ঠ রাজনীতি এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ মানস ও সংস্কৃতির ঝাণ্ডা যারা ঊর্দ্ধে তুলে ধরে রেখেছিলেন, তাঁর ভূমিকা এর মধ্যে প্রধানতম।

আহসান উল্লাহ চৌধুরী কমিউনিস্ট পার্টিকে চট্টগ্রামে সংগঠিত করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। কেন্দ্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘ সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যে কলুষিত রাজনীতির ধারা তৈরি হয়, দেশে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির উত্থান যেভাবে হয়, রাজনীতি ক্রমশঃ পুঁজিপতি-মাফিয়াদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তাতে এদেশের রাজনীতির ময়দান আহসান উল্লাহ চৌধুরীদের হারিয়ে ফেলে। তারপর তো এল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ধাক্কা। তবুও লড়াই জারি রেখেছিলেন তিনি, কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙন ঠেকালেন। এরপর যতদূর জানি, বিলুপ্তবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করা পার্টিতে দীর্ঘসময়ের অনুসৃত রাজনীতির চর্চার বদলে ভিন্ন রাজনীতির আবির্ভাবের কারণে তিনি নিজেকে সরিয়ে নেন।

এর ফলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনসহ সর্বোপরি দেশের রাজনীতির ময়দান একজন লড়াকু নেতাকে হারিয়েছে। তারপরও অসুস্থ হওয়ার আগপর্যন্ত এদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সর্বোপরি শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আহসান উল্লাহ কখনো সশরীরে, কখনো ছায়ার মতো নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। আমরা যখন ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হই, আক্ষরিক অর্থে তিনি তখন রাজনীতির পাঠ বিলানোর একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। আহসান উল্লাহ চৌধুরীদের মতো কিংবদন্তীদের লড়াইয়ের ইতিহাসকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েই আমাদের বিচরণ ছিল রাজনীতির মাঠে।

কিন্তু আহসান উল্লাহ চৌধুরীদের হারিয়ে রাজনীতির এমন অবক্ষয় হয়ে গেল, পুরো রাষ্ট্র-সমাজ চলে গেল লুটেরা, বদমাশ, ধর্ম ব্যবসায়ী, মৌলবাদী শাসকগোষ্ঠীর কবলে। যে সার্বজনীন আকাঙ্খার ভিত্তিতে দেশটা স্বাধীন হল, দেশ তার সম্পূর্ণ উল্টোপথে চলে গেল। দ্বিদলীয় বৃত্তের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী-জঙ্গিগোষ্ঠীর ক্রমউত্থান ও শক্তিসঞ্চয় এবং দেশের বাম রাজনীতির নেতৃত্বহীনতা ও ভুলের কারণে আমরা একটা চক্রের মধ্যে আটকে থাকলাম দশকের পর দশক। এর মধ্যে আরও দুঃখজনক হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম নেতৃত্বদাতা যে দল, সেই দলটি দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থেকেও দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় নিয়ে যেতে ব্যর্থ হল। বরং আমরা দেখেছি উগ্রবাদী শক্তির সঙ্গে আপসকামিতা, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের কয়েকজনকে সাজা দেওয়ার পরও তাদের রাজনীতিকে নানাভাবে প্রাসঙ্গিক করে রাখা। এর মধ্যে ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চ আশার সঞ্চার করেছিল জাতির জীবনে, কিন্তু প্রগতিশীল নেতৃত্বের ব্যর্থতায় আর আওয়ামী লীগের কুক্ষিগত করে রাখার প্রয়াসে সেটিও পথ হারাল।

এরপর চব্বিশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নামে যা হল, তাতে তো এখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া দেশটাই ব্যর্থ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। মার্কিন পরাশক্তির পরিকল্পনায় পাকিস্তানি ছকে স্বাধীনতা বিরোধী উগ্রবাদী শক্তির ভয়ঙ্কর উত্থানকাল আমরা দেখছি। বাঙালি জাতি ও দেশ পার করছে এক চরম সংকটকাল। আদৌ এদেশ সেক্যুলার বাংলাদেশ হিসেবে টিকে থাকবে না-কি মুসলিম বাংলায় রূপান্তর হয়ে যাবে, সেই আশঙ্কার মুখোমুখি এখন জাতি।

কিন্তু বাঙালি তো পরাভব মানে না। বাঙালি ঠিকই জাগবে। আর সেখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে আবারও ফিরে আসবেন কমরেড আহসান উল্লাহ চৌধুরী। ৯০ বছর বয়সে উনার দেহের মৃত্যু হয়েছে বটে, তিনি যে আদর্শের মশাল জ্বালিয়ে রেখে গেছেন, সেটাই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। তিনি একজন কিংবদন্তী শ্রমিক নেতা ছিলেন, নিঃসন্দেহে। কিন্তু তিনি একজন ভাষাসংগ্রামী, একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং একটি সার্বজনীন জাতিতাত্ত্বিক রাষ্ট্রের জন্মের প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা কিংবদন্তী রাজনীতিকও। যে লড়াইয়ের সূচনা ইতোমধ্যে হয়ে গেছে, সেখানে তিনি সব ইতিহাস নিয়েই আমাদের মাঝে হাজির হবেন এবং পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন।

কমরেড আহসান উল্লাহ চৌধুরী, লাল সালাম।

লেখক : সাবেক সাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
চট্টগ্রাম জেলা সংসদ।

Latest News

More Articles Like This

- Advertisement -spot_img